রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি নামে কয়েক প্রকার তন্ত্রের কথা আমরা জানি। এগুলোর পাশাপশি ‘ফাঁকাতন্ত্র’ নামে আরও একটি ‘তন্ত্র’ থাকা উচিত বলে মনে করি। রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। সামন্ততন্ত্র হলো ভূস্বামীদের তন্ত্র। ভূস্বামীদের স্বার্থরক্ষাসহ তাদের আচার-অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে এ তন্ত্র পরিচালিত হয়। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রই সব। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রকে জনগণের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের একমাত্র বিধাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- জনগণকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করে যে শাষণ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, তাকেই গণতন্ত্র বলে। যে তন্ত্র আমলাদের ইচ্ছায় পরিচালিত হয় কিংবা তাদের রচিত বিধি- উপবিধি দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে আমলাতন্ত্র বলে। পাশাপাশি ফাঁকাতন্ত্র সম্পর্কে বলা যায়-যে তন্ত্র ফাঁকা বিশ্বাসকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করে আবর্তিত হয় তাকে ফাঁকাতন্ত্র বলে।
জর্জ বার্নাড শ বলেছেন- ‘যাদের ঈশ্বর আকাশে থাকে, তাদের থেকে সাবধান থেকো’। আকাশ হলো ফাঁকা জায়গা।
মাদার তেরেসা বলেছেন- ‘তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালোবাসতে না পারো, তবে অদৃশ্য ঈশ্বরকে কীভাবে ভালোবাসবে!’
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৫০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি হলেও মাত্র ২০ লাখ বছর আগে মনুষ্য জীবের জন্ম। তারা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে আরও বলে থাকেন- ‘প্রচলিত ধর্মগুলোর অধিকাংশের উৎপত্তি ঘটেছে খ্রীষ্টপূর্ব ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫শ সালের মধ্যে। ঐশিবাণী প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে খ্রীষ্টধর্মের অনুসারীরা সর্বপ্রথম রাজনীতিকে ধর্মের অধীনস্থ করেন। ধর্মে উল্লেখ আছে, ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করায় মনুষ্য জীবের আদি পিতা মাতাকে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। পৃথিবী হল পাপীদের স্থান। বিধায়, পাপীদের দ্বারা নির্বাচিত কোনও প্রতিনিধি কিংবা তাদের রচিত কোন মতবাদ মনুষ্য জীবকে শুদ্ধ করতে পারে না। শুদ্ধতম রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি পেতে হলে প্রেরিত পুরুষ কিংবা তাঁদের নির্দেশিত নীতির অধীনে থাকতে হবে। শুরু হয় যাজকদের শাসন। রাজা গীর্জার অধীনে থেকে শাসন কার্য চালাতেন। উৎপত্তি ঘটে এক তরবারির তত্ত্বের।
বলা হয়, ঈশ্বর পরলোক ও ইহলোকের মুক্তির জন্য এক তরবারি দিয়ে যাজকদের প্রেরণ করেছেন । কিন্তু প্রগতির পিছনে থাকে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অস্বীকৃতির প্রবণতা। ফলে যাজকদের হাতে প্রগতিপন্থীরা নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হতে থাকেন। এমন দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে সৃষ্টি হয় রেঁনেসাসের (রেঁনেসার শাব্দিক অর্থ পুনর্জীবন কিংবা নবজাগরণ। এর সংজ্ঞায় বলা আছে - চৌদ্দ, পনের, ও ষোল শতকে ইউরোপ জুড়ে খ্রীষ্টপূর্ব গ্রীকের বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও চিত্রকলার উপর ভিত্তি করে যে জাগরণের সৃষ্টি ঘটে তাই রেঁনেসা)। ফলে রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করার বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু বাস্তবে খ্রীষ্টপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে মধ্যযুগের ধর্মবাদের সমন্বয় ঘটতে দেখা যায়। সে সময় প্রতিবাদকারীরা (Protestant) বলা শুরু করেন- যাজকরা বাইবেলের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ঈশ্বরকে উর্দ্ধাকাশে রেখে দিয়েছেন। আসলে ঈশ্বর রয়েছেন মনুষ্যলোকে। সকল সৃষ্টির মাঝেই ঈশ্বর বিরাজমান রয়েছে। ঈশ্বরকে পেতে হলে তার সৃষ্টির কল্যাণ করতে হবে। জনৈক মিশনারী প্রধান বলেছেন- ‘আমি যখন এক জন দুস্থকে সেবা করি, তখন মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বরকেই সেবা করছি’। তাঁরা ঈশ্বরপ্রাপ্তির আশায় এভাবে লক্ষ্য আর মাধ্যমের পরিবর্তন আনেন। সে সময় সৃষ্টি ঘটে দুই তরবারি তত্ত্বেরও। বলা হয় যাজকের কাজ হলো পারলৌকিক জীবনের মুক্তি খোঁজা এবং রাজনীতিবিদদের কাজ হলো ইহলৌকিক সমস্যার সমাধান বের করা। সে হিসাবে রেনেসাসের অর্থ হওয়া উচিত ‘নবজাগরণ’।
তবে কিছু ধর্মের লোকেরা রেঁনেসাসকে অস্বীকার করে বলতে থাকেন- ‘তাদের ধর্মে লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে পৌছানোর পথ উভয়ই নির্দিষ্ট করা আছে। তারাই কেবল বিশুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ ধর্মের অনুসারী। লক্ষ্য আর মাধ্যমের সামান্যতম সংস্কার বরদাস্ত করা হবে না’। এভাবে তারা বৃত্তাবদ্ধ চেতনা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকিও দিয়ে থাকে মাঝে মধ্যে। তাঁরা বিশ্বাসের আলোকে বাস্তবতাকে বলদাতে না পেরে যুগে যগে আহাজারী করে থাকে। তাঁরা ভুলে যান যে- ‘পরিবর্তন’ শব্দটি ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল। মজার বিষয় হলো বিলম্বে হলেও তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো গ্রহণ করে। তবে রেঁনেসার প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁরা আগের মত বলে থাকেন-’পার্থিব জগৎ ক্ষণস্থায়ী। পারলৌকিক জীবন দীর্ঘস্থায়ী। প্রকৃত ঈশ্বর বিশ্বাসীরা কখনও পার্থিব জগৎকে জয়ের চিন্তায় মশগুল থাকতে পারে না’।
অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক (বিশিষ্ট আধ্যাত্মবাদী নেতা) এ প্রসঙ্গে বলেন-’মানুষ পৃথিবীতে ফাঁকা হাতে আসে এবং ফাঁকা হাতে চলে যায় বটে; কিন্তু পৃথিবীতে সে পূর্বসুরীর অর্জনকে ধারণ করে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে’।
লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক। পাবনা, বাংলাদেশ।